ইনানী
পর্ব-২
হঠাৎই ঘুম থেকে জেগে উঠলো আরিয়ান। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে বুঝতে পারছে না। রাত পৌনে দুটা বাজে। বাসে মোটামুটি সবাই ঘুমচ্ছে। বাস তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব বাসগুলোর ভেতরে বসে বোঝা যায়না কত দ্রুত চলছে। বাসের ভেতর হালকা আলোয় ভেতরের পরিবেশটা মায়াবী হয়ে উঠেছে। তির্যক ভাবে হালকা আলোয় পাশের মেয়েটির অবয়ব অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত গভীর ঘুমে আছে মেয়েটা। ভাবতেই বার বার পুলকিত হয়ে উঠছে আরিয়ানের মন। পরীর মতো সুন্দর একটি মেয়ে তার দীর্ঘ পথের সহযাত্রী হয়েছে। মাত্র দুইঞ্চির ব্যবধান। মনের মধ্যে একই সঙ্গে বেজে উঠে কোকিল, ময়না আর বালিহাঁসেরা। হাল্কা কোমল একটা ঘ্রাণ ছুটে আসছে ওদিক থেকে। সম্ভবত নামনাজানা লাইট পারফিউম ব্যবহার করে মেয়েটা।
জোর করে চোখ ফিরিয়ে নেয় আরিয়ান। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। যদিও কুয়াশার জন্য বাইরেটা তেমন স্পষ্ট না। মাথা এলিয়ে বর্তমান থেকে অতীতে ফিরে যায় আরিয়ানের মন।
যুদ্ধ করেই কেটেছে ওর পেছনের জীবন। এস.এস.সি পাশ করেই গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে ভাগ্য ফেরানোর তাগিদে। পারিবারিক অক্ষমতা তার পথে বাঁধা হতে পারেনি। এসেই পড়েছে বিপাকে। গ্রাম শহরের ফারাক বুঝে গেছে দুদিনেই। শহরে এসে উঠেছিলো দুরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায়। ঠিক বাসায় নয় বারান্দার গ্রীলে টিন লাগিয়ে বানানো ছোট্ট একটা রুমে। অনেকটা উচ্ছিষ্ট খেয়ে ১টা মাস পার করেছে সেখানে। এর মধ্যে একটা কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে একটা কম্পিউটার ফার্মের পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং নাইটগার্ড হিসেবে কাজ পায় তার কলেজের এক সহপাঠির সহায়তায়। সেখানেই ষ্টোর রুমে তার থাকার ব্যবস্থা হয়।
এভাবেই শুরু হয় তার শহুরে জীবন। এরপর শুধুই চেষ্টা আর পরিশ্রম। অনার্স শেষ করে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং সবই সম্ভব হয়েছে তার চাকরীর সুবাদে। প্রতিষ্ঠানটি অনেক উন্নতি করেছে। সাথে সাথে আরিয়ানেরও। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আরিয়ানের ব্যবহার এবং যোগ্যতার কারণে তার বিভিন্ন প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তানাহলে বিশাল অংকের টাকা খরচ করে তার ইঞ্জিনিয়ারিং করা সম্ভব ছিলোনা।
সহসাই নষ্টালজিয়ার টান অনুভব করে আরিয়ান। অতীত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে। বুঝতে পারে কখন যেনো মনটা ভিজে উঠেছে। দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে বুক চিরে।
দীর্ঘশ্বাসের শব্দেইকিনা আলিভা চোখ খোলে। কাত হয়ে তার মুখের দিকে তাকায়। এই মুহুর্তে আরিয়ানের চোখ দুটো বন্ধ, কিন্তু কিছু একটা দুঃখ ভাবনা তার মন ছুয়েঁ যাচ্ছে যার প্রভাব অবয়বে পড়েছে। আলিভা মৃদু কন্ঠে বলে-
- কোন সমস্যা?
কথা শুনে চোখ খুলে তাকায় আরিয়ান। কিছুটা অবাক হয় মেয়েটার প্রশ্নের ধরন শুনে। এপর্যন্ত মেয়েটি তিনবার এভাবেই প্রশ্ন করেছে তাকে। সম্ভবত এটা তার মুদ্রাদোষ।
সোজা হয়ে বসে আরিয়ান। মাজাটা নেড়েচেড়ে একটু আড়মোড়া ভাঙ্গার চেষ্টা করে। এরপর নিজেকে কিছুটা বাঁকিয়ে আলিভার দিকে ঘুরে উত্তর দেয়-
- কই, নাতো।
- আমি হলফ করে বলতে পারি আপনি কোন কিছু নিয়ে দুঃখ ভাবনা ভাবছেন অথবা টেনশন করছেন।
- আপনার ধারণা সঠিক না।
- উহু, আমি নিশ্চিত।
- ম্যাডাম, সব সময় অভিজ্ঞতা আর অভাজার্ভেশন সঠিক তথ্য দেয় না।
- উহু, আমার মনে হয় আমার চিন্তায় ভুল নেই।
- এবার ভুল আছে। প্রথম বার বলেওতো একটা কথা আছে। হয়তো এর আগে কখনো ভুল হয়নি, কিন্তু এবার হয়েছে।
মেয়েটির নিঃসন্দেহ হলোনা। কিছুখন আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। সম্ভবত বোঝার চেষ্টা করছে। আরিয়ান আলিভার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে একটা হাসি ফিরিয়ে দেয়। তাতেও মেয়েটির সন্দেহ দুর হয় না। সহসা মুখ খোলে আরিয়ান।
- অতীত নিয়ে ভাবছিলাম। সত্যি বলতে কি আমার পেছনের সময়গুলোতে অনেক ডেডিক্যাশন আর সেক্রিফাইজ আছে। তাছাড়া খুব ষ্ট্রাগল করে এপর্যন্ত আসতে হয়েছে। সেগুলো ভাবতে গেলে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। আপনি হয়তো ব্যাপারটা বুঝবেন না, তাই আপনার কাছে লুকোতে চেয়েছি। অল্প সময়ের জন্য আমরা পাশাপাশি আছি আমাদের উচিত সময়টাকে সুন্দর কিছু ভেবে উপভোগ করা। আমার কথা অফ রাখেন, আপনার কথা বলেন। কক্সবাজারে কতদিন থাকছেন?
আরিয়ানের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো আলিভা। মনের মধ্যে কথাটা বাজছে এখনো আলিভার- “আপনি হয়তো ব্যাপারটা বুঝবেন না”। আলিভা যদিও অনেক কিছুই বোঝেনা কিন্তু অতীত দুঃখ স্মৃতি রোমন্থনের বদ অভ্যাস ওর নিজেরও আছে। কিন্তু সেকথার কোন প্রতিউত্তর করলোনা আলিভা। আরিয়ানের প্রশ্নের উত্তরের দিকে মনোযোগ দিলো।
- আপাতত কোন নির্ধারিত সময় নেই। ভালো না লাগলে কালই চলে যাবো, আর যদি ভালো লাগে তবে লম্বা সময় থাকবো। ভালোলাগা জায়গায় লম্বা সময় পার করে দেয়ার অভ্যাস আমার আছে। ঘটা করে কক্সবাজারে অবকাশ যাপনে আসা এবারই প্রথম। এর আগে এসেছি কিন্তু নির্দিষ্ট এবং অল্প সময়ের জন্য। তাই নিজের মতো করে সৈকতটাকে দেখা হয়নি। এবার ইচ্ছা আছে ঘুরে বেড়িয়ে সময় নিয়ে মনের আয়েশ মিটিয়ে দেখার।
- কিছু কিছু ব্যপারে আপনার সাথে আমার অনেকটাই মিল। আমারো খুব করে ইচ্ছে করে যতটা মনের আগ্রহ থাকে, যতটা সুন্দরকে ভালো ভাবে পাওয়া যায় ঠিক ততটাই যত্নের সাথে এবং ধীরে ধীরে পর্যবেক্ষণ করা এবং নিজের উপলব্ধিতে গেঁথে নেয়া। আর আপনার সাথে আমার পার্থক্যের জায়গাটা হলো- “অক্ষমতার আক্ষেপ”।
- বুঝলামনা।
- ভাঙ্গা ঘরের চালার ফুটো দিয়ে চাঁদ দেখেছেন কখনো?
- না, সেভাবে দেখার সুযোগ হয়নি। কেনো?
- ফুটোওয়ালা ভাঙ্গা ঘরের বাসিন্দার যতই ইচ্ছে হোক সুন্দর চাঁদ দেখতে দেখতে ঘুমোবে, তার ইচ্ছে পুরণের সময় থাকে খুবই সীমিত। যতটা সময় ফুটো বরাবর চাঁদ তার দিতে উঁকি দিয়ে থাকে। চাইলেই সে পুরো ওয়াল জুড়ে থাকা ক্রিষ্টাল গ্লাসের স্বচ্ছ বিশাল জানালা ওয়ালা লাক্সারি রুমে থেকে দীর্ঘ সময় চাদেঁর আলোয় অবগাহন করতে পারেনা। অবশ্য এটাও সত্যি, সীমিত পরিসরে চলতে থাকা মানুষগুলো একসময় তার সীমানায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোন কিছুই করার থাকেনা। অনুভুতির ধার ভোঁতা হয় বাস্তবতার নিরেট ঘষায়।
কথাগুলো বলেই আরিয়ান জানালা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে আওড়াতে থাকে তার লেখা কবিতার দুটি লাইন-
“মনের গোপন ইচ্ছেগুলো হারিয়ে ফেলি ইচ্ছে করেই
ভালো লাগা ভালোবাসার মৃত্যু ঘটে অভাব জ্বরেই”
“আর কিছু সময়ের মধ্যেই আমরা কক্সবাজারের কলাতলি ষ্টপেজে পৌছাবো, যারা কলাতলি নামবেন তাদেরকে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।”
বাসের স্পিকারে ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি বাসের লাইটগুলো জ্বলে উঠলো। ঝক়্ঝকে আলোয় ভরে উঠলো বাসের ভেতরটা। সকলেই নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে লেগে গেলো। আলিভা আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
- আপনি কোথায় নামবেন?
- আমিন নতুন বীচ মোড়ে নামবো? আপনি কোথায় নামবেন? ইনানীতে যেতে হলে আপনাকেতো কলাতলি ডলফিন মোড়েই নামতে হবে।
- হ্যা, আমি ডলফিন মোড়েই নামবো। ওখানে আমার জন্য গাড়ি থাকবার কথা।
- ও হ্যা, সি পার্ল এর নিজস্ব পরিবহন আছে।
- আপনি তো বলেছেন কক্সবাজার পৌঁছে হোটেল বুক করবেন, কিন্তু আমার মনে হয় আপনার আগেই রুম বুক করা উচিত ছিলো। কারণ আমার জানামতে এখন কক্সবাজারে শীত-মেলা চলছে। এই মেলা চলা কালীন সময়ে এতোবেশি পর্যটক আসে যে তখন এখানে রুম পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
আলিভার কথা শুনে হঠাৎই যেনো পেটে মোচড় দিয়ে উঠে আরিয়ানের। সে এটা জানে, কিন্তু এখন যে মেলা চলছে তা তার জানাই ছিলোনা। মনে হতেই মোবাইল বের করে একটা নাম্বারে ফোন করলো। এর আগে যতবার কক্সবাজার এসেছে সে এই রমিজ ড্রাইভারকে দিয়েই রুম বুক করেছে। রমিজের সাথে পরিচয় কলাতলি থেকে ইনানীতে যাবার জন্য চান্দেরগাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে। করিতকর্মা লোক। ফোন দিয়ে বললে সব কাজই করে দেয়ার জন্য একপায়ে দাড়িয়ে থাকে। সেই রমিজ মিয়ার ফোন বন্ধ। দ্রুত পরিচিত ২টি হোটেলে ফোন দিলো আরিয়ান। সবাই আন্তরিকতার সাথে তাদের অক্ষমতার কথা জানালো। কিছুটা বিমর্ষ আর নিরাশ দেখালো আরিয়ানকে। তার দিকে তাকিয়ে আলিভা বুঝতে পারলো খবর বেশি ভালো না।
- কি, রুম পেলেন?
- রুম পাইনি। আসলে যে লোকটা সব সময়ে আমাকে রুম ঠিক করে দেয় তার ফোন সুইচড অফ। তার কাছে কক্সবাজারের সকল কিছুর খবর থাকে। কোননা কোন ভাবে একটা ব্যবস্থা করে দিতো।
- তাহলেতো সমস্যা। কি করবেন এখন?
- না, সমস্যা নেই। আমি আগে ষ্ট্যান্ডে যাই। কোন একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কক্সবাজারে যখন এসে পৌঁছেছি ব্যবস্থা একটা হবেই।
- ব্যবস্থা হলেই ভালো। সকাল হতে এখনো অনেক বাকী। এতো লম্বা জার্নি করার পর শরীর চায় এখন একটা সুন্দর এবং কমফোর্টেবল তুলতুলে বিশ্রাম। এখন রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে হোটেল খুঁজতে ভালো লাগবে না।
আলিভার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিয়ে তার দিকে তাকায় আরিয়ান। এমনিতেই হোটেল ব্যবস্থা হচ্ছে না আর এই মেয়ে আমাকে তুলতুলে বিশ্রামের কথা বলে কষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্যান?
- আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু হোটেলের কাউন্টারে বসে লম্বা সময় পার করার অভিজ্ঞতা আমার আছে ম্যাডাম। আশা করছি কোন একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
আর কিছু না বলে আলিভা উঠে গিয়ে উপরের ক্যাবিন থেকে তার ব্যাগ নামাতে থাকে। বাস কলাতলি ষ্টপেজে এসে পৌঁছায়। দুহাতে দুটো বড় ব্যাগ আর একটা ছোট্ট ব্যাকপ্যাক আলিভার পিঠে। হঠাৎই চোখ তুলে আলিভা তাকায় আরিয়ানের দিকে। সেখানে কিছুটা সহানুভুতি।
- আপনি বরং আমার সঙ্গে চলুন। আশা করছি সি পার্ল এ আপনার জন্য আমি রুম ব্যবস্থা করে দিতে পারবো। এখানে আপনার রুম পাওয়াটা অনিশ্চিত।
- আরে না, আপনি এ নিয়ে টেনশন করবেন না। রুমের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আসুন আপনাকে আমি একটু সাহায্য করি।
বলেই আরিয়ান সিট থেকে বেড়িয়ে আলিভার হাত থেকে দুটো ব্যাগ অনেকটা জোর করে হাতে নিয়ে দ্রুত বাস থেকে নেমে যায়। আলিভা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। কিছু বলার কিংবা বাঁধা দেবার কোন সুযোগই পায়না। পরক্ষনেই দ্রুত নেমে আসে বাস থেকে। আরিয়ান ইতোমধ্যে ব্যাগগুলো নিয়ে বাসকাউন্টারের ভেতরে দুটো সিটের উপর রেখেছে। আলিভা ছুটে গিয়ে দাঁড়ায় আরিয়ানের সামনে। কিছুটা অনুযোগের স্বরে বলে-
- এটা কি দরকার ছিলো? আমিতো নামাতে পারতাম ব্যাগগুলো।
- তো, সমস্যা কি? আমি একটু সাহায্য করলাম, তাতে সমস্যাতো কিছু নেই। আচ্ছা ভালো থাকবেন। গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। আমি যাচ্ছি।
- আপনিও ভালো থাকবেন।
দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠলো আরিয়ান। জানালা দিয়ে দেখলো আলিভা এখনো সেভাবেই দাড়িয়ে আছে। নিজের সিটে গিয়ে বসতেই আবারো ফোন করলো রমিজের নম্বরে। নম্বর যথারীতি বন্ধ।
চূড়ান্ত টেনশন নিয়ে নতুন বীচ ষ্ট্যান্ড এ নামলো আরিয়ান। সাথে আনা একটি মাত্র ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে কাছাকাছি হোটেলগুলোতে রুমের খোঁজ করতে শুরু করলো। উহু, কোন রুম নেই। রুমতো দিতে পারছেইনা বরং সবাই রাগ দেখাচ্ছে আগে বুক না করে বোকার মতো আসার জন্য।
দুচোখ ভর্তি ঘুম আর পেটে ক্ষুধা নিয়ে যখন প্রায় ১৩ টার মতো হোটেল ঘুরে রাস্তায় নেমেছে তখন সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে। দু-পায়ে আর দাড়িয়ে থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। রাস্তার ফুটপাতেই একটা উঁচু জায়গা দেখে বসে পড়লো আরিয়ান। নিজের ভাগ্যকে সাথে রমিজকে গালাগালি করতে লাগলো। মনে হতে লাগলো আলিভার রিকোয়েষ্টাই রাখা উচিত ছিলো। এতক্ষণে হয়তো সে খেয়ে দেয়ে রিলাক্স মুডে কমফোর্টেবল তুলতুলে বিশ্রামে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ইশ, কেনোযে তখন না করতে গেলো। পরক্ষনেই বাস্তব চিন্তায় কিছুটা ধাতস্থ হয় আরিয়ান। মেয়েটি তার দায়িত্ব মনে করে রিয়োষ্টে করেছে, এটা তার ভদ্রতা, কিন্তু তাই বলে সেতো আর তার থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব নিবে না। সি পার্ল এ থাকা খাওয়া মানে আরিয়ান জানে।
কিন্তু কি করবে বুঝতে পারছে না আরিয়ান। ঘুমের চাইতে পেটের চামচিকা দৌড়ানো বন্ধ করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। আবার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাটতে শুরু করলো ও। সামনেই আরমান রেস্তরাঁ। তাও মিনিট পাঁচেক হাটতে হবে। পা টেনে টেনে হাটতে শুরু করে আরিয়ান।
এখনো সকাল হয়নি ঠিকমতো কিন্তু রেস্তরাঁ বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছে প্রচুর কাষ্টমার। কিন্তু রেস্তোরায় ঢুকেই এক সঙ্গে কয়েকটা ব্যাপার ঘটল আরিয়ানের। প্রথমতঃ হার্টের দুটো বিট মিস করল। দ্বিতীয়তঃ তার হাত থেকে ব্যাগ-টা নিচে পড়ে গেলো আর যেটা হলো সেটা হলো তার জীবনের সব চাইতে আশ্চর্যজনক দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠালাে।
নীরবে খেয়ে যাচ্ছে আরিয়ান। বলা যায় গোগ্রাসে খাচ্ছে। মনে হচ্ছে জীবনের শেষ খাওয়া খাচ্ছে। তার সম্মুখে বসা একজন অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণী যে নিজে না খেয়ে আশ্চর্য হয়ে তার খাওয়া দেখছে সেটা আরিয়ান খেয়ালই করছে না।
খাওয়া শেষে যখন গরম চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়াল তখন আরিয়ান খেয়াল করল সামনে বসা মেয়েটি অর্থাৎ আলিভা নাস্তা নিয়ে বসে আছে।
- আপনি তো কিচ্ছু খাচ্ছেন না! আসলে খিদেয় চোখে মুখে আন্ধার দেখছিলাম। খেয়ে নিন। আর আমাকে বলেন আপনি এখানে কি করে? আপনার তো এই সময় এয়ারকন্ডিশন্ড রুমের দুগ্ধ ফেনিল বিছানায় ঘুমিয়ে থাকার কথা।
রেস্তোরায় ঢুকেই আলিভাকে দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল আরিয়ান। আলিভার কাছে গিয়ে দাড়াতেই আলিভা কোন কথা না বলে চুপচাপ নাস্তা খেতে বসতে বললো। আরিয়ান আর কোন কথা না বলে বেসিনে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসে গেছে।
- সমস্যা নেই। আমি খাচ্ছি। এবার বলুন আপনি কি হোটেল রুম পেয়েছেন?
- না, এখনো পাইনি।
- আমিতো আপনাকে আগেই বলেছিলাম। এসময়ে এখানে আগে বুকিং ছাড়া রুম পাওয়া দুষ্কর।
- হুম, তাইতে দেখছি।
- তো আর কি ভাবছেন?
- ভাবছি একটা তাবু কিনে ঝাউ বনে গিয়ে থাকবো। ব্যাপারটা অবশ্য মন্দ হয়না। নতুন একটা অভিজ্ঞতা হয়ে যাবে।
- আপনি তাহলে জানেন না যে লোকাল প্রশাসন রাতে সমুদ্র সৈকতে এবং ঝাউবনে যাওয়া আইন করে বন্ধ করেছে?
- ওহ, তাহলে কি করা যায়?
কথার মাঝেই আরিয়ান পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাকে যেনো ফোন দিলো। ফোন কানে লাগিয়েই খুশি হয়ে উঠে সে। রমিজের ফোন বাজছে। অপর প্রান্ত থেকে মফিজ ফোন ধরে। কিছুখন কথা বলার পরে ফোন কেটে দেয় আরিয়ান। ভ্রূ-কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে আলিভা।
- রমিজের সাথে কথা হয়েছে। যদিও বলেছে রুম পাওয়া কঠিন হবে, কিন্তু ও রাজি হয়েছে আমাকে রুম খুঁজে দেয়ার। এক্ষুনি চলে আসবে। এবার বলুনতো আমাকে খুজেঁ পেলেন কি করে? আপনারতো এখন এখানে থাকার কথা নয়?
- আসলে আপনি আমার ব্যাগগুলো নামিয়ে দিয়ে চলে এলেন, আমি কিছুটা চিন্তিত ছিলাম। কারণ আমি জানি আপনি অনেকটা আগ্রহ নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। এসে যদি আপনার মন মতো রুম না পান তবে আপনার ট্যুরটাই বোরিং হয়ে যাবে। তাই ভাবলাম আপনি রুম পাওয়া পর্যন্ত আপনার সাথে থাকি।
- কিন্তু আপনি আমাকে এখানে খুজেঁ পেলেন কি করে?
- মর্ডান টেকনোলজির সাথে থাকা একজন হয়ে আপনি আমাকে একথা জিজ্ঞেস করছেন? আপনার জানা থাকার কথা বাসে সিট বুকিং দেয়ার সময় তাদেরকে ফোন নম্বর দেয়া হয়। আমি সহজেই বাসের পেসেঞ্জাল লিষ্ট থেকে আপনার মোবাইল নম্বর কালেক্ট করে নিয়েছি। তাছাড়া ফোন নম্বর থাকলে গুগুলতো জানাবেই এ নম্বরটা কোথায় আছে। তাইনা?
আশ্চর্য হয়ে সামনে বসা অনিন্দ সুন্দর মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে আরিয়ান। অল্প সময় পাশাশাপি ছিলো ওরা। তেমন কোন জানা শোনাও হয়নি তাদের মধ্যে। কিন্তু স্বাভাবিক কৌতুহল এবং সহযোগিতা প্রবণতা মেয়েটাকে হোটেল রুমের আরাম ছেড়ে এখানে নিয়ে এসেছে। ভাবতেই ভালো লাগলো আরিয়ানের। মেয়েটা অন্যরকম। ব্যক্তিত্বের ব্যপারেও সজাগ বলে আরিয়ানকে কোন প্রকার জোর করছেনা। কিন্তু আলিভা চাচ্ছে আরিয়ানের রুম পাওয়ার ব্যপারে সে সহযোগিতা করুক।
এরই মধ্যে রমিজ চলে এসেছে। ওরা দুজনেই রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আসলো। আলিভাকে উদ্দেশ্য করে আরিয়ান বলল-
- আপনি এমনিতেই অনেক কষ্ট করেছেন। এবার আপনি আপনার হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম করুন। আশা করছি রমিজ আমাকে একটা রুম খুজেঁ দিতে পারবে।
- রুম পাওয়া পর্যন্ত আপনাদের সাথে থাকলে কোন সমস্যা হবে? কিছুখন থাকি আপনাদের সাথে?
আরিয়ান কোন মন্তব্য না করে রাজি হয়ে গেলো। রমিজের চান্দেরগাড়িতে করেই ওরা রুম খোঁজা শুরু করলো। রমিজ জিজ্ঞেস করলো-
- ভাইজান, বলছিলেন আপনার একার জন্য রুম লাগবে, এখনতো দেখতেছি দুইজন?
রমিজের কথায় ওরা দুজনই কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলো। আরিয়ান বুঝতে পারছেনা সহজে কি জবাব দেয়া যায়। মুখ খুলল আলিভা-
- রমিজ ভাই, আপনি শুধু আপনার ভাইজানের জন্যই রুম খুঁজে দেন। আমার রুম ঠিক করা আছে। আপনার ভাইজানের রুমে পেয়ে গেলেই আমি চলে যাবো।
আর কোন কথা বলল না রমিজ। শুরু হলো রুম খোঁজা। ঘন্টা খানেকের মধ্যে প্রায় ১০/১২ জায়গায় যাওয়া হলো। কিন্তু ২/১টা ছাড়া সবাই না করে দিলো। আর যেগুলোতে রুম আছে সেগুলোতে আরিয়ান থাকতে পারবে না। অনেকটা বস্তির মতো। এরিমধ্যে কক্সবাজারের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরু হয়েছে। রাস্তায় প্রচুর মানুষ। মনে হচ্ছে পুরো বাংলাদেশের সকল পর্যটক এসে উপস্থিত হয়েছে এখানে। কৌতুহল নিয়ে আলিভা আর আরিয়ান দেখছে চারদিক। ওদের দেখে মনে হচ্ছেনা রুম না পাওয়ার টেনশন বলতে কিছু আছে। একটা বাচ্চা ছেলে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে যাচ্ছিলো। আলিভা গাড়ি থামিয়ে হাওয়াই মিঠাই নিয়ে নিলো সবার জন্য।
আলিভা বাচ্চাদের মতো হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে আর অন্যরা ঘুরে ফিরে তার খাওয়া দেখছে। গোলাপি হাওয়াই মিঠাই খেয়ে এক পর্যায়ে আলিভার ঠোঁটও গোলাপী হয়ে উঠলো। মেকাপহীন আলিভার ন্যাচারাল লিপষ্টিক দেয়া ঠোঁট গুলো দেখে আরিয়ান অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ইচ্ছে হচ্ছে ওই দুটো দুষ্টু ঠোঁট গুলোর জন্য আমৃত্যু এমেয়ের প্রেমে পরে যেতে। নিজের আঙ্গুল ছুঁইয়ে ঠোঁট থেকে অতিরিক্ত রংগুলো নিংড়ে নিতে। যে রং আগুন জ্বালায় হৃদয়ে সে রং খুবই ভয়ংকর। গাড়ি থামতেই আরিয়ানের চিন্তায় ছন্দপতন হয়। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে মনকে গালাগাল দিতে থাকে আর মনের ভেতর থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে সব রং।
নাহ্, এবারের হোটেলটাতেও হলো না। রমিজের মধ্যেও এখন হতাশা দেখা দিয়েছে। রুম ঠিক করে দিতে পারলে ওরা হোটেল মালিকের কাছ থেকে একটা কমিশন পায়। বোঝা যাচ্ছে তার কপাল আজ মন্দ। এমনিতেই হোটেল সব ফিলাপ, এর মধ্যে ভাইজানের আবার যেনোতেনো রুম হলে চলবে না।
এক পর্যায়ে রমিজ তার অক্ষমতার কথা স্বীকার করে। মনটা খারাপ হয়ে আছে রমিজের। সকালটাই আজ ব্যর্থতা দিয়ে শুরু হলো। আরিয়ানের মুখটাও শুকিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে। চোখ তুলে তাকাতে পারছেনা আলিভার দিকে। খুব করে বলেছিলো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রমিজ আর আরিয়ানের গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হনে হাসছে আলিভা। আলিভা আগেই অনুমাান করেছিলো এটাই হবে। মুখ ঘুরিয়ে আরিয়ানের দিকে ফিরে বসলো আলিভা।
- এবার?
- এবার, আর কি? শালা ঢাকাই ফিরে যাবো।
অজান্তে গালি এসে যাওয়ায় স্যরি বলল আরিয়ান। মাথা কাজ করছেনা তার। বাজেটের কথা মাথায় না থাকলে ঠিকই আলিভার সি পার্ল এ গিয়ে উঠতো প্রথমেই।
- আপনার চেষ্টা যদি শেষ হয়ে থাকে তবে এবার আমাকে একটু সুযোগ দেন। চলুত দেখি সি পার্ল এ রুম পাওয়া যায় কিনা। সেখানে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে আশা করছি।
- কিন্তু ম্যাডাম আপনি বুঝতে পারছেন না ঐ হোটেলের সিড়িঘরে রুম নেয়ার সামর্থও আমার নেই।
- আপনার বাজেট কতো এবং কতদিন থাকবেন?
- সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা করে ধরেন ৫ দিন।
- ফিরে না গিয়ে এক কাজ করলে হয় না, ৫ হাজার টাকা করে ২ দিন অন্তত থাকুন।
সাথে সাথে আরিয়ানের পছন্দ হলো পরিকল্পনাটা। বিফল হয়ে ফিরে না গিয়ে অন্তত ২টা দিন থেকে গেলে মন্দ হয় না। তাছাড়া প্রিয় বীচ অর্থাৎ ইনানীতে থাকতে পারার চিন্তা আসতেই আরিয়ানের মন খুশিতে ভরে গেলো। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উত্তর না দিয়ে বোকার মতো সোজা সাপ্টা রাজি হয়ে গেলো আলিভার কথায়। আলিভাও মনে হলো খুশি হলো। আলিভা রমিজকে উদ্দেশ্য করে বলল-
- রমিজ ভাই, চলো।
- কই যামু আপা?
- কক্সবাজার পুলিশ ষ্টেশনে চলো।
আলিভার কথা শুনে ওরা দুজনই ফিরে তাকালো। ওদের তাকানো দেখে হেসে ফেললো আলিভা। চারিদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। ওর খুব ভালো লাগছে। ইতিমধ্যে রোদ তেতে উঠেছে। ব্যাকপ্যাক থেকে একটা সুন্দর সোনালী ফ্রেমের সানগ্লাস বের করে চোখে দিয়েছে আলিভা। হালকা নীল শেড দেয়া সানগ্লাসটা তাকে হঠাৎ করেই সুপার মডেলদের মতো লুক দিয়েছে। আড় চোখে তাকাছে আরিয়ান। ভয়ার্ত কন্ঠে রমিজ বলল-
- থানায় ক্যান আপা?
- আরে থানায় না, বলেছি পুলিশ ষ্টেশনে যেতে। পুলিশ ষ্টেশনের সাথেই কস্তুরী রেস্তোরা। কস্তুরীতে সকালে হালিম দিয়ে রুটি খেতে অসাম লাগে। তাড়াতাড়ি চলো রমিজ ভাই। সকালে ঠিক মতো খাওয়া হয় নাই। ওখানে গিয়ে পেট ভরে খাবো।
আলিভার কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো। দীর্ঘ পরিশ্রমের পর পেট পুজার চাইতে বড় আনন্দদায়ক আর কিছু নেই।
কলাতলিতে নামিয়ে দিয়ে গেলো রমিজ। আরিয়ান খেয়াল করলো সি পার্ল এর লগো লাগানো কালো রং এর একটা কার অপেক্ষা করছে ওদের জন্য। অবাক হয়ে আলিভার দিকে তাকালো আরিয়ান। আলিভা এর কোন জবাব না দিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠতে তাগাদা দিলো।
অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকাইয়া যায়। এ প্রবাদটি সত্যি প্রমানিত হলো। সকালেও আলিভা খবর নিয়ে জেনেছে যে সিংগেল একটা রুম খালি আছে এর বুকিং ক্যান্সেল হওয়ার কারণে। কিন্তু হোটেলের কাউন্টারের রিসিপশনিষ্ট সুন্দর করে তাকে জানালো যে রুমটা আবারো কনফার্ম করেছে এর বোর্ডার।
পর্যাপ্ত নিরাশ হয়ে হোটেল লবির সোফায় ধপাস করে বসে পড়লো আরিয়ান। বুঝতে পারছে এবার ভাগ্য তার সাথে নেই। আলিভার মনটাও কিছুটা ভার। উঠে গিয়ে হোটেল এর কয়েক জন ষ্টাফের সাথে কথা বললো ও। কিছুখন পরে ফিরে এলো। বলল-
- আজ কোন রুম খালি নেই। তবে আগামীকাল সকালে একটা রুম খালি হবে। যদি আজকের জন্য আপাতত কোন ব্যবস্থা করা যায় তবে আর সমস্যা হবে না। দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। আপাতত ফ্রেশ হয়ে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে এরপর ভেবে দেখবো কি করা যায়। কিছু মনে না করলে আপাতত আমার রুমে আসুন। ফ্রেশ হওয়া জরুরী। এরপরেই আমরা রুম খুঁজতে বেড়িয়ে পরবো।
আলিভার কথা শুনে আশ্চার্য হয়ে মুখ তুলে তাকালো আরিয়ান। কথাটা সহজে বললেও ব্যপারটা ছোট নয়। একা একটা মেয়ে আছে একটা রুমে। সেখানে যদি সহানুভূতি দেখিয়ে কিংবা সাহায্য করেও কাউকে নেয়া হয় সেটা শুনতে কিংবা দেখতে ভালো দেখায় না। আরিয়ান বুঝতে পারছেনা কি করবে। অথচ ক্লান্তিতে জড়িয়ে আসছে দুচোখ। শাওয়ার নিতে পারলে অনেকটা ভালো লাগতো। এযাবত মেয়েটাকে যতটা দেখেছে মনে হচ্ছে মেয়েটার এতটুকু সহায়তা দায়িত্ব নিয়ে করার মতো ক্ষমতা আছে। আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না আরিয়ান। কোন প্রশ্ন না করে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ালো।
ডিজিটাল কার্ড স্পর্শ করে রুমের দরজা খুলল আলিভা। রুমের ভেতরে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলো আরিয়ান। ঢুকেই বিশাল বড় একটা ড্রইং রুম। সুন্দর ও আধুনিক। রুমে ঢুকেই হাতের ব্যাগটা পাশে রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো আরিয়ান। আলিভা পর্দা সরিয়ে অন্য রুমে প্রবেশ করলো। ড্রইং রুমের সাথেই বাথরুম। আলিভাকে জিজ্ঞেস করার কোন চেষ্টা না করে ব্যাগ খুলে তোয়ালে বের করে নিয়ে প্রবেশ করলো বাথরুমে। আপাতত শাওয়ার না নিলে ক্লান্তি যাবেনা। আরিয়ান খুব দ্রুত গোসল করে। ১০ মিনিটের মধ্যেই বাথরুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
বেড়িয়েই দেখে আলিভা রুমের মাঝে দাড়িয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে। তাকে গোসল সেরে বেড় হতে দেখে আশ্চর্য হলো। তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আরিয়ান বলল-
- গোসল সেরে ফেল্লাম। গোসলের পর খুব ফ্রেশ লাগছে।
- এই অল্প সময়ের মধ্যে আপনি শাওয়ার সেরেছেন?
মুচকি হেসে মাথা দোলালো আরিয়ান। তোয়েলেটা হাতে নিয়ে সোফায় গিলে বসলো ও। রুমের এদিক ওদিক তাকাচ্ছে কোথাও অল্প সময়ের জন্য তোয়ালেটা ছড়িয়ে দেয়ার যায় কিনা। আলিভা এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে তোয়ালেটা নিয়ে যেতে যেতে বলল-
- বাথরুমেতো তোয়ালে দেয়া থাকে। সেটা ইউজ করলেই পারতেন।
পর্দা সরিয়ে অন্য ঘরে চলে গেলো আলিভা। বোঝা যাচ্ছে অন্য রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় তোয়ালে ছড়াতে গেছে সে। সোফায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমে জড়িয়ে আসতে চাইলো চোখে। আলিভা ফিরে এসে দেখলো আরিয়ান সোফায় হেলান দিয়ে ঢুলছে। বুঝতে পারলো গোসলের পর শরিরে ক্লান্তি ভর করেছে।
- এখানে বসে না থেকে ও রুমে আসুন।
আলিভার কথা শুনে সোজা হয়ে বসলো আরিয়ান। বুঝতে পারছেনা অন্য রুমে অর্থাৎ আলিভার রুমে যাওয়াটা তার জন্য ঠিক হবে কিনা। অনিচ্ছা স্বত্বেও আলিভার পেছন পেছন পাশের রুমে প্রবেশ করলো। রুমে ঢুকেই বুঝলো আসলে সে প্রথমেই হিসেবে ভুল করেছে। সে খেয়াল করলেই দেখতে পেতো যে আলিভার রুমটা আসলে কোন সাধারণ রুম নয়। এটা একটা ভিআইপি ডিলাক্স রুম। ড্রইং রুম ছাড়াও রয়েছে বিশাল বিশাল আলাদা দুটি বেড রুম। প্রতিটি রুমের একপাশ পুরোটাই গ্লাসের। এবং রয়েছে বিশাল সাইজের বেলকনী। অবাক হয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছে রুমগুলো। পর্দা সড়াতেই বেরিয়ে পড়লো বিশাল গ্লাসের ওয়াল। অবাক হয়ে দেখলো সমুদ্রের পুরোটাই যেনো সামনে ছুটে চলে এসেছে।
ওয়াও বলে চিৎকার করে বিশাল গ্লাসের জানালার এক পাশের গ্লাস সরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। সমুদ্রের ভেঁজা সোঁদা গন্ধে মনে মাদকতা এনে দিলো মুহুর্তেই। দুহাত ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে আরিয়ান। আশেপাশের কোন কিছুর উপরই যেনো কোন খেয়াল নেই তার।
এভাবে কতক্ষণ ছিলো জানেনা আরিয়ান। সমুদ্রের নীল পানির উথাল পাথাল ঢেউ আর পাড়ে আছড়ে পড়ার শব্দে পরিবেশটাকে পাগল করে তুলেছে। পাশ ফিরে দেখলো আলিভা রেলিং এ দুহাত রেখে অপলক তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে।
অনন্তর ছুটে চলা বৈষ্ণবি জীবন আমার
ক্ষয়ে যাওয়া লয়ে যাওয়ার হয়নিতো শেষ,
বরাবরে আমি ছিলাম চপলা চঞ্চল
তৃষিত মনে আছে না পাওয়ার ক্লেশ।
স্বগোক্তির মতো করে আবৃত্তি করলো আলিভা। পরিবেশ, পরিস্থিতি আর সময়ের সাথে যোগ হয়েছে অপার্থিব এক স্বর্গীয় কন্ঠের দ্যোতনা। আবেগে ভরপুর কথা গুলো ইথারে ভাসতে থাকলো অনেক ক্ষন। আরিয়ান বোবা চাহনিতে দেখতে থাকে আলিভাকে। চুপচাপ সময় বয়ে চলে। আলিভা আড় হয়ে ফিরে তাকিয়েছে আরিয়ানের দিকে। মুখের ভাষা বন্ধ করে চোখের ভাষায় শুধু প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে।
কেমন তরো মানুষ তুমি? কোথায় তোমার বাস?
মনে তোমার ইচ্ছেটা কি, করছো সর্বনাশ!!!
দুজনের কথা হতে থাকে ওয়ান ওয়ে। কেউ কারো কথা শুনতে পায় না। শুধু বলেই চলে মনে মনে। সময় চলতে থাকে সেকেন্ড হিসেবে।
নোনা জলের ঢেউয়ের প্রচন্ডতায়
বালিয়াড়ি ভেঙ্গে হয় সর্বনাশা।
এলবাট্রস ভেসে থাকে বাতাসে
হারায়না কখনো পথের দিশা।
হঠাৎই সম্বিৎ ফিরে পায় আলিভা। তার রুমে একজন গেষ্ট আছে। তাকে আপ্যায়ন করাটা জরুরী। দ্রুত রুমে ফিরে এসে ইন্টারকমে দুকাপ কফি অর্ডার দিয়ে ফিরে আসে বারান্দায়।
- আসুন, একটু রেষ্ট নিয়ে নেয়া যাক। পাশে আরো একটি রুম আছে এটার মতোই। আপনি ওখানে বিশ্রাম নিতে পারবেন। তারপরই আমরা বেরুবো।
- না, না। বিশ্রাম নিতে হবে না। আসুন বেড়িয়ে পড়ি। একটা কাজ করা যেতে পারে। আপনি বরং রিলাক্স হয়ে কিছুটা ঘুমিয়ে নেন। আমি এর মধ্যে খুঁজে দেখি আশেপাশে কোথাও ব্যবস্থা হয় কিনা।
- উহু। সেটা হচ্ছে না। কফি আসছে। এর মধ্যে আমি ওয়াশ হয়ে নিবো। এরপর দুজনে বারান্দায় বসে কফি খাবো। এরপর একসংগে বেরুবো। এখানেতো আমি বেড়াতেই এসেছি। আপনার সাথে বেড়াতে গেলে আপনার কোন সমস্যা না থাকলে আমার কোন অসুবিধা নেই।
বলেই আর কিছু কথা না বলে রুমের ভেতরে চলে যায় আলিভা। মিনিট দশেক পরেই কফি এলে দুজনে বারান্দায় বসে কফি খায়। মুখে তেমন কোন কথা না হলেও প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অনেক কথা বলতে থাকে দুজনেই। কফি খাওয়া শেষ হতেই আলিভা বলে উঠে-
- আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তবে বলবো আমরা যদি অন্তত অল্প একটু সময় বিশ্রাম নিয়ে নিতে পারতাম তবে বাইরে গেলে আমাদের কারোরই খারাপ লাগতো না।
কথাটা শুনে আরিয়ান বুঝতে পারলো আরিয়ান শুধু নিজের কথাই ভাবছে। আলিভাকে বিশ্রামের সুযোগ দেয়া উচিত। তাই কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। পাশের রুমে গিয়ে অভিভুত হয়ে গেলো সে। এটা অন্যটার চাইতেও বড়। বিশাল বড় বিছানা, সোফা, ফ্রিজ, বিশাল প্লাজমা টিভি। বুঝতে পারছে বিশাল বড় যৌলুসের কারখানা এটা। আলিভা আপাতত বিদায় নিয়ে তার রুমে চলে গেলো। আরিয়ান কিছু সময় সোফায় বসে থাকলো। ঝিমুনি আসাতে বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলো। মুহুর্তেই মনে হলো কোমল মাখনের মধ্যে শরির ঢুবে গেলো। এমন বিছানায় এর আগে শোবার সুযোগ হয়নি ওর। আয়েশে আরামে আর ক্লান্তিতে কয়েক মুহুর্তেই তার ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ হতে থাকে।
আলিভা তরিঘরি গোসল সেরে নেয়। কাপড় পাল্টিয়ে একটা জিন্স এর সাথে ম্যাচ করে ফতুয়া পড়ে। ঘরময় হেটে বেড়ায় কিছুক্ষন। বারান্দায় গিয়ে মন দিয়ে সমুদ্র দেখে আর ফুসফুস ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নেয়। প্রয়োজনীয় কিছু কথা শেষে যখন ফোনটা বিছানার পাশে রেখে বালিশে মাথা রাখলো তখন কিছু একটা মনে হতেই উঠে বসলো। ইতোমধ্যে প্রায় ঘন্টা খানেক পার হয়ে গেছে। আরিয়ান যদি রেষ্ট নেয়া শেষ করে অপেক্ষা করে তবে আর না শোয়াই ভালো হবে। আলতো করে পর্দা সরিয়ে উঁকি দেয় আরিয়ানের রুমে। ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ পেয়ে বিরক্ত না করে এসে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লো আলিভা।
পৌষের শেষের দিকটাতে শীত খুব জেঁকে বসেনা কিন্তু জানান দেয় “আমি চলে এসেছি”। সে সময়টাতে দক্ষীণা বাতাস যদিও শীত জাগানিয়া কিন্তু ওভরঅল ওয়েদারটা অসাম। শরিরে ঠান্ডার পরোশ বুলিয়ে যায় সময় অসময়। রাতের বেলাতে যদিও লেপ-কম্বল ভালো করে মুড়িয়ে না শুলে শীত কাটেনা কিন্তু দিনের বেলাটা কিছুটা অন্যরকম। বাইরে রৌদ্র কিছুটা প্রখর থাকে কিন্তু ঘরের ভেতরে ঠান্ডা সহজে কাটেনা। দিনের বেলাতেও পাশ ফিরে কুল হয়ে থাকা লেপটাকে আদর করে কাছে টেনে নিয়ে এর ভিতরে বিড়ালের মতো আপাদমস্তক গুঁজে ঘুমোতে বড্ড ভালো লাগে। দিনগুলো তুলনামুলক ছোট্ট থাকে তাই একবার বিছানায় গেলে দৌড়ে সময় পেড়িয়ে যায়।
হঠাৎই ঘুম ভেগে যায় আলিভার। জেগেই প্রথমে দেয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িতে চোখ চলে যায়। দুুপুর ১:১৮। দ্রুত উঠে পাশের ঘরে উকিঁ দেয়। ভেবেছিলে আরিয়ান উঠে হয়তো ওর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু না, বেচারা বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। ফিরে এসে বারান্দায় দাঁড়ায় আলিভা। দৃষ্টি চলে যায় সৈকতের বালিয়াড়িতে। দুপুরের রোদ পরে চক়্চক়্ করছে নোনা জল। দুরের সীমানাহীন সমুদ্রে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হারিয়ে যায় অজনায়। দক্ষীণা বাতাসে চুল উড়ে এসে স্পর্শ করে মুখে-ঠোটেঁ-নাকে আর গালে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে আলিভার। মনের মধ্যে ভালোলাগার স্পর্শ টের পায়। বোঝেনা এ অনুভুতিগুলো নতুন, নাকি আগেও এর উপস্থিতি ছিলো গোপনে হৃদয়ে কিন্তু টের পায়নি। চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থাকে। বুকের ভেতর মৃদু কম্পন টের পায়। চোখের পাতা হঠাৎই কেঁপে যায়। দুপা শক্তি হারায়। পাশে রাখা ইজিচেয়ারটাতে বসে পড়ে। পা-দুটো ঠেকায় বারান্দার গ্রীলে। মেনিকিউর করা নখ দিয়ে খোঁচা দেয় এখানে সেখানে। সফট লিলেন প্লাজুটা উঠে এসে ফর্সা পা-দুটো সহসাই অনেকটাই অনাবৃত করে ফেলে। ঢেউয়ের মতো দুলে উঠে ইজি চেয়ার। আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে আলিভার। সম্ভবত এই প্রথম তার হৃদয়ে কিছু ঢুকে পরেছে যার সাথে আলিভার কোন পূর্ব পরিচয় নেই। মনের বিভিন্ন অলি গলিতে ঢু-মারছে সে অবাঞ্ছিত স্পাইয়ের মতো। ইশৎ কাঁত হয়ে চোখ তুলে তাকায় সে। গ্রীলের ফাঁক গলে তার ফোকাস লেন্সের সীমানা লম্বা হতে হতে অসীমের দিকে ছোটে। দুরে বহুদুরে সীমান্তের কালো রেখার বর্ডারও তার গতি রোধে ব্যর্থ হয়।
আলিভা সময়কে খুব প্রাধান্য দিয়ে চলে। সব সময় বর্তমানকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করে বলেই তার তেমন কোন ব্যর্থ অতীত নেই। জীবনের মুল্যায়নে সে সবসময় মেধা আর বিবেচনাকে ব্যবহার করেছে। তাই পেছনের জন্য তার মধ্যে বিন্দু মাত্র গ্লানি কিংবা আক্ষেপ নেই।
-০-