আজ আমার ছোট ছেলের জন্য বিশেষ দিন। গতকাল থেকেই প্রিপারেশন নিচ্ছে। ওর স্কুলে আজ বার্ষিক প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান। শার্টিং শুর্টিং করে মাঞ্জা মেরে স্কুলে গেলো। তার চোখে মুখে আনন্দ।
ওর স্কুল আর আমাদের বাসার মাঝে মাত্র একটা জমির ফারাক। আমার জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকালেই স্কুল দেখা যায়।
হঠাৎ করেই বিশাল শব্দ। সাউন্ডবক্সের প্রচন্ড শব্দে কেপে উঠলো চারিদিক। আমার বুকের মধ্যে বাজতে লাগলো সে শব্দ। মানুষের শব্দ গ্রহণ করার ক্ষমতা নির্দিষ্ট। বিশেষ করে কানের পর্দা ১৪০ ডেসিবল পর্যন্ত সহ্য করতে পারে। এরপর গেলে পর্দা ফেটে যাবার আশংকা থাকে। সম্ভোবত শব্দের উপর কিছু নিয়মও আছে কোন পর্যন্ত শব্দ বাজানো যাবে। কিন্তু আমার মনে হলো স্কুলের সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাজানো শব্দের মাত্রা আমাদের কানের সহ্য ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
আমি জানিনা এতো বিশাল মাপের শব্দ তৈরী কেনো প্রয়োজন। অনুষ্ঠান পরিচালিত হওয়া স্থানের মানুষগুলো যাতে শুনতে পায় এতটুকুর বেশি শব্দ তৈরী করার কোন প্রয়োজন নেই। কারন অনুষ্ঠান যারা আয়োজন করছে তারা আছে অনুষ্ঠান নিয়ে, কিন্তু আমিতো অনুষ্ঠান নিয়ে নাও থাকতে পারি। যেমন আমার বড় ছেলে আগামী দিন পরেই এস.এস.সি পরীক্ষা দিবে। তার কাছে এ শব্দ কোন কাজেই আসছে না। তার জন্য প্রয়োজন এখন সুন্দর এবং সুষ্ঠু পরিবেশ। আর যারা বৃদ্ধ অথবা অসুস্থ তাদের কথাতো আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রতিটা শব্দের ধাক্কার সাথে সাথে তারা বিরক্ত হয়। আর ছোট্ট বাচ্চারা আৎকে আৎকে উঠে।
যে শব্দ বেশিরভাগ জনসাধারণের বিরক্তির কারণ হয়, সমস্যা হয়, অসুবিধা হয় সে শব্দকে অবশ্যই দুষিত শব্দ বলা যায়। আমরা অনবরত এই সব দুষিত শব্দ ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সহ্য করছি। আমি জানিনা কেনো সহ্য করছি। সম্ভোবত আমরা সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছি। যেমন বছরের শেষ দিকে প্রতিটি পরিবারে ২/১ জন পরিক্ষার্থী থাকে যারা বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে তার সারা বছরের পড়ালেখার রেজাল্ট পাবে। কিন্তু এই সময়টা গান-বাজনা, ওরশ ও ওয়াজ-মাহফিল এর মতো অনুষ্ঠানগুলোর আয়োজন সর্বোচ্চ মাত্রায় দেখা যায়। আর এ অনুষ্ঠানে অসংখ্যা উচ্চ মাত্রার মাইক ও সাউন্ডবক্স ব্যবহার করার ফলে লেখাপড়ার বারোটা বাজে। যদিও এখানে অনেকেই আমাকে ওয়াজের বিরুদ্ধে কথা বলছি বলবেন। আমার কথা এখানে অনুষ্ঠান নিয়ে নয়। আমার কথা দুষিত শব্দ নিয়ে। দুষিত শব্দ সব ক্ষেত্রেই দুষিত। ওয়াজে হোক অথবা যাত্রায় হোক আমার মতে শব্দের মাত্রা অবশ্যই দুষনের বাইরে রাখা উচিত।
ধর্মীয় মুল্যবোধ ছিকায় উঠিয়ে যারা ডিজে গানে স্টেজ মাতাচ্ছেন তাদের নিয়ে আমার কোন কথা নেই। আমার কথা মানবিকতা নিয়ে, আমার কথা আমার অধিকার নিয়ে। যে শব্দ আমার জীবনের স্বাভাবিক গতিকে রোধ করে, আমার সন্তানের স্বাভাবিক বেড়ে উঠাকে বাধাগ্রস্থ্য করে সে শব্দ থেকে আমাকে বেচে থাকতে দিন।
যারা এ শব্দ দুষনকে সঠিক বলে ভাবছেন তাদের কাছে অনুরোধ, প্লিজ আমাকে শব্দ দুষনের উপকরিতা সম্পর্কে ধারনা দিন। অন্যথায় দুষনটাকে বন্ধ করুন।
শেষ কথাঃ
আমি জানি আইন করে সব কিছু করা সম্ভব নয়। আমরা যদি এ দুষনের সাথে গা ভাসিয়ে দিয়ে সুখ বোধ করি তবে কোন আইনই আমাকে শব্দ দুষনের হাত থেকে রেহাই দিতে পারবে না। আর যদি আমরা মনে করি আর একদিনও শব্দ দুষন চলবে না তবেই সম্ভব।
আরেকটা কথাঃ যারা তাদের সন্তানদের দুষিত শব্দকে সঠিক বলে জ্ঞান দিচ্ছেন তারা তাদের বৃদ্ধ বয়সে অথবা অসুস্থতার সময় সহ্য ক্ষমতা আরো বাড়ানোর চেষ্টায় মনোযোগী হোন।
আর এও অসম্ভব নয় যে, আমাদের সন্তানেরা আমাদের মৃত্যুর পর কুলখানীতে বিাশাল পেন্ডেল করো, শক্তিশালি সাউন্ড বক্স এনে মৃত বাবা-মার জন্য তালে তালে নাচছে আর ডিজে বাজাচ্ছে- "ফাইট্টা যায়, আমার বুকটা ফাইট্টা যায়...."