সচরাচর আমার বৈশিষ্টের মধ্যে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোয় আগ্রহ, ইচ্ছে, উদ্দিপনা এমনকি আবেগ কিছু নেই। যে কারনে আশে পাশের ঘটনাগুলো সাধারণত আমায় কোনো ভাবে নাড়ায় না।
কিন্তু আজ হঠাৎ করেই ইচ্ছেতে ব্যত্যয় ঘটলো।
হোমনাতে হঠাৎ করেই একটা অভাবনীয় কাজ হলো। মানুষের চাহিদা ও স্রোতের বিপরীতের একটা ঘঠনা ঘটলো। একটা পাবলিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো। লোকাল খবর গুলোতে সব সময়ই দেখি “নসু ঘোষ কেঁদেছে”, “পলক পলক ফেলেছে”, “আজ হারাধনের মুরগির ৪র্থ জন্ম দিন” এসকল বিষয়ের খবরে খুব মাতামাতি। অথচ হোমনায় একটি আধুনিক, সুন্দর, রুচিশীল, ব্যতিক্রমী, দৃষ্টিনন্দন লাইব্রেরী রয়েছে এর উপর তেমন কোনো তথ্যমুলক কনটেন্ট চোখে পরেনি। যাহোক, এ বিষয় নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাইনা, এটা আমার টপিক নয়।
ফিদা
কে বা কারা এই বিশাল কাজটি করেছে তা আমার স্পষ্ট জানা নেই, তবে যেহেতু লাইব্রেরী নামের সাথে “উপজেলা প্রশাসন” নামটা জুড়ে দেয়া সেহেতু বোঝা যায় এর সাথে লোকাল প্রাশাসন যুক্ত আছেন। যেহেতু তিনি/তাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মী সেহেতু এসকল কাজ তাঁর/তাদেঁর দায়িত্বের মধ্যে পরে, তাই এ জন্য তাকে আলাদা করে ধন্যবাদ দেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। কিন্তু তার রুচি, চেষ্টা, সুদুরপ্রসারী ভাবনা, সিলেকশন, একাগ্রতা আমাকে যারপরনাই মোহিত করেছে। জানিনা এক্ষেত্রে “ফিদা” শব্দটা যথেষ্ট কিনা, কিন্তু বার বার মনে হচ্ছে- “ওনার/ওনাদের এই গুনগুলোর উপর আমি ফিদা হয়ে গেছি”।
অহংকার
অহংকার যদিও ভালো কিছু নয়, কিন্তু আমি একজন “ভালো পাঠক” এই নিয়ে আমার নিজের প্রতি ছোটখাটো একটা অহংকার রয়েছে। সরে-অ, সরে-আ, ক, খ শেখার পর থেকেই বই পড়া, বিশেষ করে একাডেমীক বইয়ের বাইরের বই পড়ার প্রতি আমার মাত্রাতিরিক্ত ফেসিনেশন কাজ করে। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে বাবা যখন ফিনল্যান্ড থেকে ফেরার পথে সে দেশের শিক্ষা ও প্রযুক্তির উপর বেশ কিছু বই এনে আমাকে উপহার দিলেন তখন থেকে শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, প্রকৃতি সহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর জানা ও পড়া আমার নেশার মধ্যে যুক্ত হয়ে গেছে। হাজার হাজার বই আনন্দের সাথে পড়েছি, পড়ছি এবং ইনশাআল্লাহ আমৃত্যু পড়ে যাবো।
যা বলছিলাম, হোমনায় লাইব্রেরী হয়েছে এটা আমার জন্য যথেষ্ট গর্বের ও আনন্দের। পেছনের লম্বা সময় আমি নিজেই এমন একটা লাইব্রেরী গড়ার স্বপ্ন দেখেছি, এখনো দেখছি। তাই সুযোগ পেলেই চকচকে দৃষ্টিতে লাইব্রেরীটির দিতে তাকিয়ে থাকি এবং ফ্রি থাকলে ভেতেরে গিয়ে এর ঠান্ডা ও শুনশান পরিবেশে গিয়ে বই নেড়েচেড়ে দেখি। খুব যে ভালো লাগে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
আমার নিজ চোখে দেখা ও স্বশরিরে গিয়ে
জানার সুযোগ হয়েছে যে সকল লাইব্রেরী সেগুলো হলো-
(১) “গণ উন্নয়ন গ্রন্থাগার”, হোমনা, কুমিল্লা।
(২) “সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার”, শাহবাগ, ঢাকা।
(৩) “মোহাম্মদ আলী লাইব্রেরী”, জাকারিয়া ষ্ট্রিট, কলকাতা।
(৪) “Vellore জেলা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি”, ভেলর। (ভেতর ঢুকতে পারি নাই)
(৫) “National Library of the Philippines”, ম্যানিলা, ফিলিপাইন।
(৬) “National Library of China (中国国家图书馆)”, বেইজিং, চায়না।
উপরের তালিকাটা আমার পছন্দের তালিকা, কিন্তু পুরো তালিকা নয়। পুরো তালিকা অনেক লম্বা। বিভিন্ন অফলাইন লাইব্রেরী এর পাশাপাশি অসংখ্য অনলাইন পাঠাগার দেখা ও জানার সুযোগ আমার হয়েছে। পাশাপাশি লাইব্রেরীর প্রতি মাত্রারিক্ত আগ্রহের কারণে দু-একটি লাইব্রেরী মেনেজমেন্ট কোর্সও সম্পন্ন করেছি স্বউদ্যোগে। যে কারনে এর উপর আমার কিছু ধারনা তৈরী হয়েছে।
হোমনা উপজেলা প্রশাসন পাবলিক লাইব্রেরীর সকল বই এর ডাটাবেইজটি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। বর্তমানে এই ডাটাবেইজে মোট ১১শত এর উপরে বই এর তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। নি:সন্দেহে এ সংখ্যা একটি লাইব্রেরীর প্রাথমিক সময়ের জন্য অনেক বড়। আশা করছি দ্রুতই এর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।
যে কারনে আমার এ লেখা,
আসুন সেটা জানার চেষ্টা করি:
ইতিমধ্যে বলেছি যে, লাইব্রেরীর প্রতি ফেসিনেশন থাকার কারনে এর সম্পর্কে অনেক কিছুই আমার জানার সুযোগ হয়েছে। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে হোমনা উপজেলা প্রশাসন পাবলিক লাইব্রেরী সম্পর্কে কিছু মন্তব্য ও পরামর্শ দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি।
লাইব্রেরীতে সাধারণ মানুষকে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন আয়োজন করতে হবে। যেমন- রেজিষ্ট্রেশন করলে তাকে বই অথবা অন্য কিছু উপহার দেয়া, যারা রেগুলার পড়তে আসবে, পড়বে তাদেরকে বিভিন্ন অকেশনে পুরস্কৃত করা। বিষয় ভিত্তিক পড়ায় আগ্রহী করে তোলা, সে বিষয়ের উপর পরীক্ষা নেয়া ও পুরস্কৃত করা।
পাঠাকদের কাছ থেকে ফিডব্যাক নেয়ার ব্যবস্থা করা, তারা কি বই চায়, কোনটা প্রয়োজন, কোনটার চাহিদা কম, কোনো সমস্যা আছে কিনা- এসব তথ্য লাইব্রেরীয়ানের মাধ্যমে সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করা।
অনলাইনে অবশ্যই ভালো ভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা এবং পাঠাগারে কি কি বই আছে সেগুলো যেনো মানুষ ক্যাটাগরী ভিত্তিক সহজে খুজতে ও দেখতে পারে তার জন্য একটা অনলাইন ডাটাবেইজ তৈরী করা।
লাইব্রেরীর বইয়ের তালিকা ও পাঠকের ডাটা হতে হবে সাবলীল বাংলা ভাষায়। এতে অনেক ধরনের সুবিধা রয়েছে। বিশেষ করে পাঠক সহজে তাদের পছন্দের বই খুজে পাবে এবং আগ্রহী হয়ে উঠে।
প্রতিটি বই পড়া শেষে পাঠকদের “রিভিউ” দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সে রিভিউগুলো যুক্ত হবে অনলাইন ডাটাবেইজে। এতে পাঠক আগ্রহী হবে, অন্যরা প্রেরনা পাবে।
লাইব্রেরীর প্রতিটি তথ্য, পাঠকদের একটিভিটি সকল কিছু অনলাইনে/ফেইজবুক পেইজে নিয়ে আসতে হবে, যাতে অন্যরাও উৎসাহ পায় ও আগ্রহী হয়ে উঠে।
লাইব্রেরী ঠিক ভাবে পরিচালনার জন্য অসাধারণ ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠি পাশাপাশি সিলেক্ট করতে হবে সাধারণ পাঠক ও সাধারণ পাঠাকদের পালস বুঝতে পারা ব্যক্তি ও গোষ্ঠিকে।
সাসটেইন
বহু বছর আগে যখন ডিসি অফিসে প্রবেশের ইজি এক্সেস ছিলো তখন তৎকালিক ডিসি স্যারের মুখে প্রথম শুনেছিলাম- “আমরা সাসটেইনেবল উন্নয়ন চাই”। তখন ভালো করে বুঝিনি “সাসটেইনেবল” এর তাৎপর্য কি। কিন্তু পরবর্তীতে বুঝতে পেরেছি- ছোট বেলার সেই কথাটি- “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন” এর ইংরেজী ও মার্ডান ভার্সন হলো “সাসটেইনেবল”। রুচি আর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বড়-ছোট অনেক কিছুই করে ফেলা যায়, কিন্তু লম্বা সময় সেটাকে ধরে রাখা, লালন করা, উন্নত করা এবং জীবিত রাখা সত্যিই কঠিন। কিছু দ্বিধাতো আছেই, কারণ- এই ছোট্ট জীবনে অনেক “দাওয়াখানা”কে “পার্টি অফিস” এমনকি অলিখিত “নেশাঘর” হতে দেখেছি।
শুভকামনা “হোমনা উপজেলা প্রশাসন পাবলিক লাইব্রেরী” ও এর সকল কলা-কুশলীদের প্রতি।