বাদ দে - “বুইড়া মানুষ”

আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু মানুষকে লক্ষ্য করে এমন ধরনের মন্তব্য করে থাকি। অবশ্য এভাবে বলার যুক্তি যুক্ত কারণও থাকে (অনেক ক্ষেত্রে)। যেমন- মানুষটা আসলেই বৃদ্ধ হয়ে গেছে। কোনো কিছু করতে গেলে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। কখন কি করতে হবে বা বলতে হবে তা বোঝার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। অনেকক্ষেত্রে শারিরিক অসুস্থ্যতার জন্যও এমনটা হয়। এ অবস্থায় অল্পতে ধৈর্য্য হারা হয়ে যায়, নিজের উপর বিরক্ত হয়, অন্যের কাজ কর্ম বিরক্ত লাগে, লম্বা সময় কোনো কাজ করলে নিজের উপর ব্যালেন্সহীন হয়ে পরে, ইত্যাদি। 

এখানে দুটি পয়েন্ট উল্লেখ করছি:

(এক) ভুল হওয়া, ভুল হওয়া বুঝতে পারা, ভুল হয়েছে স্বীকার করে নেয়াই ভালো মনে করা এবং 

(দুই) ভুল হলেও বুঝতে না পারা, ভুল হয়েছে স্বীকার না করা, ভুল স্বীকার না করার জন্য চুড়ান্ত চেষ্টা তর্ক করা।


দুটি পয়েন্টের উপর পর্যালোচনা:

১। ধরুন আপনার ২ বছরের বাচ্চাটি আইসক্রীম খেতে নিয়ে হাত থেকে ফেলে দিলো। আপনি তখন তাকে কোমল গলায় বললেন- “আহারে বাবা, আইসক্রীম পড়ে গেছে? আচ্ছা তুমি কেঁদোনা, আমি তোমাকে আরেকটি আইসক্রীম কিনে দিচ্ছি”।

২। আপনার ৪-৫ বছরের বাচ্চাটি আইসক্রীম খেতে নিয়ে হাত থেকে ফেলে দিলো। আপনি তখন তাকে রেগে বললেন- “এটা কি হলো, কিভাবে ধরলা যে হাত থেকে আইসক্রীম পড়ে গেলো?”।

৩। আপনার ৬০ বছরের বাবা আইসক্রীম খেতে নিয়ে হাত থেকে আইসক্রীম পরে গেলো। আপনি তখন তাকে বললেন- “বাবা, তোমাকেতো আগেই বলেছি আমি খাইয়ে দেই, তুমি নিজে নিজে খেতে পারবেনা, এখন কেমন হলো, বলোতো?”।

পার্থক্য: আপনি তিন সময়ে একই কাজে তিন ধরনের রিএকশন দেখিয়েছেন। কারণ, এখানে তিনটি ঘটনা তিন বয়সের মনুষ ঘটিয়েছে। আপনি একেক বয়সের মানুষের সাথে একেক ধরনের আচরন করেছেন। সম্ভোবত এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। (বয়সের ক্ষেত্রে)

এখন আমরা (এক) ও (দুই) এ ফিরে যাই। (দুই) এর মত কাজ করা হয় সাধারণত ছোট থেকে মধ্য বয়স হবার আগ পর্যন্ত। এ সময় রক্ত গরম থাকে, রক্তে প্রকট বৈশিষ্ট্যগুলো দ্রুত এবং সর্বোচ্চ কাজ করে এবং নিজেকে বিজয়ী এবং ভুলের উর্ধে প্রমান করার জন্য প্রানান্ত একটা চেষ্টা থাকে। তাই এ সময়টাতে ভুলে অথবা নাভুলেও মানুষ নিজেকে ভুল ও অশুদ্ধ প্রমান করে ফেলে। নিজের চেষ্টায় অথবা চেষ্টা ছাড়া ভুলের মধ্যে জড়িয়ে থাকাটা খুব বেশি বড় কিছু মনে হয়না।

কিন্তু এক সময় শরিরের রক্ত ঠান্ডা হতে থাকে। শক্তিতে ঘাটতি দেখা দেয় সাথে ধৈর্যেও। সময়ে অসময়ে ভুল হয়ে যায়, যার ফলে নিজের উপর কনফিডেন্স কমতে থাকে। কিছু কিছু মানুষ যদিও ঘাড়ের ত্যাড়া রগের কারনে শেষ পর্যন্ত ত্যাড়াই চলতে চেষ্টা করে কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় শিথীলতা, ছাড় দেয়ার মন মানুষিকতা। এরা (এক) এর মতো মানুষ। ভুল স্বীকার করে নিয়ে অবস্থা ঠান্ডা রাখাকে গুরুত্ব দেয়। এটা ভেবে ওরা স্বস্তি পায় যে, “আমার একটু সেক্রিফাইজের জন্য যদি শান্তি বজায় থাকে, তবে তাই হোক”। বয়সী এবং অসুস্থ্য এমন মানুষগুলো নিজেকে এসময় গুটিয়ে নিতে চেষ্টা করে। অনেক কিছু দেখে এবং শুনে অন্ধ ও বধির হবার অভিনয় শিখে নেয়। ত্যাড়া মানুষদের কথা বলছি না, বলছি স্বাভাবিক গোবেচারা মানুষগুলোর কথা। এরা (এক) এর মতো করে চলাকে খুশি মনে মেনে নেয়। এখানে এসে (ওয়ান), (টু) ও (থ্রী) ধরনের বিষয়ের বুৎপত্তি ঘটে।

বুৎপত্তি (ওয়ান): আশে পাশের মানুষ দ্রুতই (এক) ধরনের মানুষদেরকে অকর্মন্য ও গোবেচারা হিসেবে গ্রহন করে নেয়। এদের কথা ও কাজের গুরুত্ব কমতে থাকে। পরিবার তথা কাছের মানুষগুলো কিছু দিনেই বুঝে নেয় - “এর ওয়ারেন্টি পেরিয়ড শেষ হয়ে এসেছে”। কাছের মানুষগুলো গুরুত্ব দেয়ার ভান করে এদেরকে গুরুত্ব দেয় ঠিকই কিন্তু সে সব ভান অচিরেই বিভিন্ন ক্রিড়া ও কলাপে প্রমান হতে থাকে। (এক) প্রকার মানুষটি অল্প সময়েই বুঝে যায়- শান্তি ও শৃংখ্যলার জন্য যে ছাড় সে দিয়েছে তার ফলাফল আসতে শুরু করেছে। মানুষ ছাড় সেগুলোকে “ছাড়” নয় “দুর্বলতা” হিসেবে গ্রহন করেছে। আরো কিছু দিন যাবার পর মানুষটি বুঝতে পারে- ভালোর জন্য যে ভালো কাজ সে করেছে তার ফলাফল মহা ভালো নয় খুব খারাপ হিসেবে তার দিকে ফিরে আসার জন্য তৈরী হয়েছে।

বুৎপত্তি (টু): ভালো কাজের খারাপ ফলাফল পেয়ে নিজেদেরকে সুন্দর আর সুস্থ্য রাখতে এরা দ্রুতই ব্যর্থ হয়ে পড়ে। জীবনের প্রতি তাদের আগ্রহ ও উদ্দিপনার যে শক্তি তাতে ঘুনে ধরে। ঝর ঝরে হয়ে ঝড়ে পড়ে অল্প অথবা লম্বা সময় কষ্ট ভোগের পর।

বুৎপত্তি (থ্রী): কাছের মানুষদের মধ্যে যখন (এক) প্রকারের মানুষের মনের দু:খ এবং অন্যদের জন্য সেক্রিফাইজগুলো ধরা পরে তখন বিষয়টা অসুন্দর থেকে সুন্দরের দিকে দ্রুতই টার্ন নেয়। এই মানুষটাকে তারা তাদের আচরনে বুঝিয়ে দেয়- “তুমিই ভালো, আমাদের জন্য ভালো, তুমি এমনই থাকো”। তখন সেই বুঝতে পারা কাছের মানুষগুলো তাকে তার মতো করে শেষ পর্যন্ত বাঁচতে সাহায্য করে। এ সাহায্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে হয়- (ক) তাকে গুরুত্ব দিয়ে, (খ) তার কথা ও কাজের অমুল্যায়ন করা থেকে বিরত থাকে, (গ) তাকে ভালো বলে, (ঘ) তাকে সবাই পছন্দ করে এটা সবাই তাদের কাজে কর্মে (এক) মানুষটিকে বুঝিয়ে দিয়ে। 

শেষ কথা: ভাবুনতো, আপনার প্রিয় মানুষটা এই মাত্র শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছে আপনারই কোলে। মৃত্যুর সময় সে আপনারই দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার দৃষ্টিতে আনন্দ, মুখে তৃপ্তির চিহ্ন। আর যে দুফোটা অশ্রু ঝড়ে পড়েছে চোখের কোন বেয়ে সেগুলো সত্যিকারের “আনন্দাশ্রু”।